প্রয়োজনে প্রিয়জন
মানুষ সামাজিক জীব। সম্পর্ক, ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব—এই তিনটি শব্দ যেন জীবনের পরিপূর্ণতার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু বর্তমান সমাজের বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের সঙ্গে প্রয়োজনের সমীকরণ মিলে গিয়ে সম্পর্কগুলো হয়ে উঠেছে স্বার্থকেন্দ্রিক। তাই আজকাল যে মানুষটির সঙ্গে আমরা প্রতিদিন কথা বলি, যাকে সবচেয়ে কাছের মানুষ ভাবি—সে-ও হয়ে উঠতে পারে শুধুই "প্রয়োজনের প্রিয়জন"।
প্রিয়জন = প্রয়োজন
এ কথাটির গভীরে গেলে দেখা যায়, জীবনের অধিকাংশ সম্পর্কই গড়ে ওঠে পারস্পরিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে। যখন আমাদের কিছু দেওয়ার মতো থাকে—টাকা, সময়, সাহায্য বা সামাজিক মর্যাদা—তখন আমরা অনেকের কাছেই প্রিয় হয়ে উঠি। কিন্তু সেই সবকিছু হারিয়ে গেলে সম্পর্কগুলো একে একে ফিকে হয়ে যায়।
ক্যারিয়ার না থাকলে ভালোবাসাও থাকে না
একজন তরুণ যখন ক্যারিয়ারে পিছিয়ে পড়েন, তখন দেখা যায় তার ভালোবাসার মানুষও তাকে ভুলে যেতে শুরু করে। যাকে একসময় “আল্লাহকে সাক্ষী রেখে” জীবনের সঙ্গী হওয়ার কথা দিয়েছিল, সেও আজ আর মনে রাখে না সেই প্রতিশ্রুতি। একমাত্র কারণ—তার এখন আর সেই প্রয়োজন নেই। বাস্তবতা হলো, ক্যারিয়ারহীন একজন মানুষ সমাজে নিজেকে টিকিয়ে রাখাই কঠিন, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা তো দূরের কথা।
টাকার অভাবে বন্ধুরাও দূরে সরে যায়
আজ আপনার কাছে যদি অর্থ না থাকে, কাল আপনি হয়তো ফেসবুকে দেখবেন—আপনার বন্ধুরা সবাই মিলে আনন্দ করছে, অথচ আপনাকে কেউ ডাকেনি। তখন হয়তো মনে হবে—আপনি কি তাদের বন্ধুই ছিলেন না? কিন্তু যদি আজ আপনার ব্যাংক ব্যালেন্সটা ভারী হতো, সেই ছবিতে হয়তো আপনিও থাকতেন। এমনটাই হয়ে উঠেছে আমাদের সমাজের মানসিকতা।
সত্য হলেও বিষাক্ত
এই কথাগুলো যেমন কঠিন, তেমনি সত্য। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সম্পর্কও ফুরিয়ে যায়—এমন দৃশ্য আজ আমাদের আশপাশে প্রতিনিয়ত দেখা যায়। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, এমনকি ভালোবাসার মানুষ পর্যন্ত প্রয়োজন ফুরালে আপনাকে ভুলে যাবে। যতক্ষণ আপনি কিছু দিতে পারেন, ততক্ষণ আপনি প্রিয়। সেই জায়গা থেকে প্রশ্ন উঠে—এটা কি সত্যিকারের প্রিয়জন, না কি প্রয়োজননির্ভর এক অভিনয়?
উপসংহার
সব সম্পর্কই প্রয়োজনের নয়—এমন মানুষ এখনো আছে, যারা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে, পাশে থাকে। তবে তারা বিরল। তাই সমাজের এই কঠিন বাস্তবতায় নিজেকে প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন। নিজের মূল্য নিজেই তৈরি করতে হবে, কারণ পৃথিবীতে এমন কেউ হয়তো নেই যে নিঃস্বার্থে সবার হয়ে ওঠে প্রিয়। তাই নিজের শক্তি, ক্যারিয়ার ও আত্মমর্যাদাকে গুরুত্ব দিন। প্রয়োজনে প্রিয় হয়ে ওঠার চেয়ে, নিজের কাছে সত্য থাকা অনেক বেশি মূল্যবান।
শেষ কথা
প্রয়োজনে যে প্রিয় হয়, সে প্রয়োজন ফুরালেই অপ্রিয় হয়ে যায়। তাই চোখ খোলা রাখুন, মন বুঝুন, এবং নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজেই নিন।
প্রয়োজনে প্রিয়জন
(একটি নীরব উপলব্ধি)
প্রিয়জন ছিল একদিন, খুব আপন—তেমনই মনে হতো,
ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব মিলে জীবন যেন রঙে রঙিন ছিল তো।
তবু হঠাৎ বুঝে গেলাম, হিসাবটা ছিল ভিন্ন,
প্রিয়জন মানেই প্রয়োজন—ভালোবাসা ছিল শর্তসাপেক্ষ ঋণ।
ক্যারিয়ার যখন শূন্য, আমিও হলাম ভুলে যাওয়া এক নাম,
যার চোখে ছিল স্বপ্ন, আজ তার ঠোঁটে নেই আর কোনো গান।
আল্লাহকে সাক্ষী রেখে দেওয়া সেই কথাগুলো?
ভেসে গেছে সময়ের নদীতে—নেই আর কোনো আলো।
টাকার হিসাবেও ছিল বন্ধুদের ভালোবাসা,
জমে থাকা ছবির ফ্রেমে নেই আজ আমার হাসা।
ওরা হাসে একসাথে, গল্পে খোশমেজাজে ভাসে,
আর আমি? শুধু স্ক্রিনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি নীরবে পাশে।
আজ যদি থাকতো পকেটে রঙিন কিছু নোট,
তবে হয়তো ডাক পড়তো, কেউ বলতো, “ভাই, কতদিন তোর খোঁজ পাই না!”
কিন্তু এখন আমি অপ্রয়োজনীয়, অজুহাতে মুছে যাওয়া এক স্মৃতি,
বন্ধু, আত্মীয়, প্রিয়জন—সবাই আজ ব্যস্ত নিজের গীতিতে।
বিষাক্ত শোনাবে? হোক,
তবু সত্য তো এটাই—
ভালোবাসা আজ প্রয়োজনের মুখোশে,
আর প্রিয়জন?
সে তো কেবল সুযোগের অতিথি।
আপেল মাহমুদ