"বোশেখ" কবিতার ক্লাস নোট
১. কবি পরিচিতি
নাম: আল মাহমুদ
জন্ম: ১৯৩৬ সাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোরাইল গ্রামে
মৃত্যু: ২০১৯ সাল
প্রকৃত নাম: মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ
পেশা: সাংবাদিকতা এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক
অনুপ্রেরণা: মুক্তিযুদ্ধ
কাব্যিক বৈশিষ্ট্য: লোকজ শব্দের প্রয়োগ এবং ঐতিহ্যপ্রীতি
উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া
শিশুতোষ কবিতা: পাখির কাছে ফুলের কাছে
সংকলন: "বোশেখ" কবিতাটি কবির 'কবিতা সমগ্র' কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে
২. কবিতার মূলভাব ও প্রেক্ষাপট
"বোশেখ" কবিতাটি বৈশাখ মাস এবং কালবৈশাখী ঝড়কে কেন্দ্র করে রচিত। কবি বৈশাখী ঝড়ের ধ্বংসাত্মক রূপ এবং এর ফলে গরীব ও অসহায় মানুষের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছেন। কবিতায় সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
৩. কবিতার বিশ্লেষণ (গুরুত্বপূর্ণ পঙ্ক্তি ও ধারণা)
বৈশাখী বাতাসের ধ্বংসাত্মক রূপ: কবি বৈশাখের প্রচণ্ড শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন বুনোহাঁসের ঝাঁক ভেঙে যাওয়া, জেটের পাখা দুমড়ে আছাড় মারা, নদীর পানি শূন্যে তুলে ছড়ানো এবং টেলিগ্রাফের থাম নুইয়ে দেওয়ার চিত্রের মাধ্যমে।
কবির মিনতি: কবি বৈশাখী বাতাসের কাছে স্থির হতে বা থেমে যেতে অনুরোধ করছেন। তিনি প্রশ্ন করছেন, গরীব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে, চাষের ভিটে গুঁড়িয়ে, টুনটুনিদের বাসা ছিঁড়ে এবং দুঃখী মায়ের ভাতের হাঁড়ি উল্টে ফেলে বাতাস কী আনন্দ পায়?
পৌরাণিক ও সাহিত্যিক প্রসঙ্গ:
হনুমান: রামায়ণে বর্ণিত হনুমানকে বাতাসের দেবতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কালিদাসের মেঘদূত: কালিদাসের কাব্যে মেঘ ও বাতাসকে দয়ালু হিসেবে দেখানো হয়েছে।
সামাজিক বৈষম্য: কবি সমাজের বৈষম্য তুলে ধরেছেন। ঝড় গরীবের ঘর ভেঙে দিলেও, অন্যায়ভাবে ধনীদের গড়ে তোলা প্রাসাদ অক্ষত থাকে।
বাদশাহ সুলাইমানের বাহন: নবী সুলাইমান (আঃ) বাতাসকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্ব শাসন করতেন এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকাঙ্ক্ষা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাতাসের কাছে মিনতি করেছিলেন, যাতে তা পুরানো, শুষ্ক, মরা ও অদরকারী সবকিছুকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।
কবির আহ্বান: কবি বাতাসকে আহ্বান করছেন, যদি ধ্বংস করতেই হয়, তবে সমাজের বিভেদ সৃষ্টিকারী, অত্যাচারী ও শোষকদের ধ্বংস করুক।
৪. পাঠ পরিচিতি (গুরুত্বপূর্ণ সারাংশ)
এই কবিতায় বৈশাখের বিধ্বংসী প্রতীকের মধ্য দিয়ে কবি অত্যাচারীর অবসান কামনা করেছেন, যাতে সমাজ থেকে অত্যাচারী মানুষরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
আল মাহমুদ-এর "বোশেখ" কবিতার প্রতিটি লাইনের ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো:
প্রথম স্তবক: বৈশাখের ধ্বংসাত্মক রূপ
"যে বাতাসে বুনোহাঁসের ঝাঁক ভেঙে যায়
জেটের পাখা দুমড়ে শেষে আছাড় মারে,
নদীর পানি শূন্যে তুলে দেয় ছড়িয়ে
নুয়ে দেয় টেলিগ্রাফের থামগুলোকে—"
ব্যাখ্যা: এখানে কবি কালবৈশাখী ঝড়ের প্রচণ্ড শক্তি ও ধ্বংসলীলার ছবি এঁকেছেন। এই ঝড়ের দাপটে বুনো হাঁসের দল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, এমনকি আধুনিক শক্তিশালী জেট বিমানের ডানা পর্যন্ত দুমড়ে-মুচড়ে নিচে আছড়ে পড়ে। বাতাস এতই শক্তিশালী যে তা নদীর জলকে শূন্যে তুলে চারপাশে ছড়িয়ে দেয় এবং টেলিগ্রাফের শক্ত খুঁটিগুলোকেও বাঁকিয়ে ফেলে। এর মাধ্যমে কবি মূলত ঝড়ের প্রলয়ঙ্করী রূপকে তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয় স্তবক: ঝড়ের কাছে কবির মিনতি
"সেই পবনের কাছে আমার এই মিনতি:
তিষ্ঠ হও, তিষ্ঠ, মহাপ্রতাপশালী,"
ব্যাখ্যা: ঝড়ের এই ধ্বংসাত্মক রূপ দেখে কবি সেই বাতাসের কাছেই অনুরোধ করছেন। তিনি বাতাসকে ‘মহাপ্রতাপশালী’ সম্বোধন করে তাকে শান্ত হতে বা থেমে যেতে বলছেন।
তৃতীয় স্তবক: গরিবের দুর্দশার চিত্র
"গরিব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে কি লাভ?
কি সুখ বলো গুঁড়িয়ে দিয়ে চাষীর ভিটে?
বেগুনপাতার বাসা ছিঁড়ে টুনটুনিদের
উল্টে ফেলে দুঃখী মায়ের ভাতের হাঁড়ি,
হে দেবতা, বলো, তোমার কি আনন্দ,
কি মজা পাও বাবুই পাখির ঘর উড়িয়ে?"
ব্যাখ্যা: এই অংশে কবি ঝড়ের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, কেন সে দুর্বল ও অসহায়দের ওপর আঘাত হানে। গরিব মাঝির নৌকার পাল ছিঁড়ে বা কৃষকের বাড়িঘর ধ্বংস করে বাতাসের কী লাভ হয়? টুনটুনি পাখির ছোট বাসা বা গরিব মায়ের ভাতের হাঁড়ি উল্টে দিয়ে সে কী সুখ পায়? কবি বাতাসকে 'দেবতা' সম্বোধন করে বাবুই পাখির সুন্দর বাসা নষ্ট করার পেছনের আনন্দ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এর মাধ্যমে মূলত প্রকৃতির এই রুদ্র রূপের কাছে মানুষের অসহায়ত্ব এবং গরীবের প্রতি বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠেছে।
চতুর্থ স্তবক: পৌরাণিক ও সাহিত্যিক প্রসঙ্গ
"রামায়ণে পড়েছি যার কীর্তি-গাথা
সে-মহাবীর হনুমানের পিতা তুমি,
কালিদাসের মেঘদূতে যার কথা আছে
তুমি নাকি সে-দয়ালু মেঘের সাথী?"
ব্যাখ্যা: কবি এখানে বাতাসকে তার পৌরাণিক পরিচয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। রামায়ণে বাতাসকে মহাবীর হনুমানের পিতা বলা হয়েছে, যিনি শক্তির প্রতীক। আবার, মহাকবি কালিদাসের 'মেঘদূত' কাব্যে বাতাসকে দয়ালু মেঘের সঙ্গী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যে কিনা বিরহী যক্ষের বার্তা বয়ে নিয়ে যায়। কবি প্রশ্ন করছেন, যার এমন গৌরবময় পরিচয়, সে কেন এত নিষ্ঠুর আচরণ করছে?
পঞ্চম স্তবক: সামাজিক বৈষম্য
"তবে এমন নিঠুর কেন হলে, বাতাস,
উড়িয়ে নিলে গরিব চাষীর ঘরের খুঁটি?
কিন্তু যারা লোক ঠকিয়ে প্রাসাদ গড়ে
তাদের কোনো ইট খসাতে পারলে না তো!"
ব্যাখ্যা: এই অংশে কবি সরাসরি সামাজিক বৈষম্যের কথা বলেছেন। তিনি বাতাসকে প্রশ্ন করেন, কেন সে কেবল গরিব চাষির ঘরের চাল, খুঁটি উড়িয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু যারা সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে বড় বড় প্রাসাদ তৈরি করেছে, তাদের একটা ইটও খসাতে পারে না? এর মাধ্যমে কবি প্রকৃতির সাথে সমাজের ধনী-গরিবের বৈষম্যের এক দারুণ মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন।
ষষ্ঠ স্তবক: সুবিচারের আকাঙ্ক্ষা
"হায়রে কত সুবিচারের গল্প শুনি,
তুমি নাকি বাহন ছিলে বাদশাহ্ সোলেমানের—
যার তলোয়ারে অত্যাচারের কাটতো মাথা,
অহমিকায় অট্টালিকা গুঁড়িয়ে দিতো"
ব্যাখ্যা: এখানে কবি কিংবদন্তির কথা স্মরণ করেছেন।传说 অনুযায়ী, বাতাস ছিলেন বাদশাহ সোলেমান (সলোমন)-এর বাহন, যিনি ছিলেন একজন ন্যায়বিচারক। তাঁর তরবারির আঘাতে অত্যাচারীর মাথা কাটা পড়ত এবং অহংকারীর প্রাসাদ মাটিতে মিশে যেত। কবি বাতাসকে সেই ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
সপ্তম স্তবক: রবীন্দ্রনাথের আহ্বান
"কবিদের এক মহান রাজা রবীন্দ্রনাথও
তোমার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন করজোড়ে—"
ব্যাখ্যা: কবি এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গ টেনেছেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর কবিতায় কালবৈশাখীর কাছে সমাজের সব জীর্ণ, পুরাতন ও অন্যায়ের প্রতীককে ধ্বংস করে নতুন দিনের সূচনা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
অষ্টম স্তবক: কবির চূড়ান্ত আহ্বান
"ধ্বংস যদি করবে, তবে শোনো, তুফান,
ধ্বংস করো বিভেদকারী পরগাছাদের।
পরের শ্রমে গড়ছে যারা মস্ত দালান,
বাড়তি তাদের বাহাদুরি গুঁড়িয়ে ফেলো।"
ব্যাখ্যা: কবিতার শেষে কবি বাতাসকে তার ধ্বংসের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, যদি ধ্বংস করতেই হয়, তবে সমাজের বিভেদ সৃষ্টিকারী, শোষক ও অত্যাচারীদের ধ্বংস করো। যারা অন্যের শ্রম শোষণ করে নিজেদের সম্পদ ও প্রাসাদ গড়ে তুলেছে, তাদের অহংকার ও দম্ভকে চূর্ণ করে দাও। এভাবেই কবি বৈশাখী ঝড়কে সামাজিক अन्याय দূর করার এক বিপ্লবী শক্তি হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।