জীবন বিনিময় - গোলাম মোস্তফা
ভূমিকা:
কবিতাটি শুরু হয় সম্রাট বাবরের দুশ্চিন্তা দিয়ে। তার পুত্র হুমায়ুন গুরুতর অসুস্থ এবং মৃত্যুর কাছাকাছি। বাবর তার পুত্রকে বাঁচাতে সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছেন, কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না।
"বাদশাহ বাবর কাঁদিয়া ফিরিছে নিদ নাহি চোখে তার," -
- সম্রাট বাবর তার পুত্রের অসুস্থতায় এতটাই কাতর যে তার চোখে ঘুম নেই। তিনি সারা রাজ্য জুড়ে বিচলিত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
"পুত্র তাহার হুমায়ুন বুঝি বাঁচে নাই এবার আর,"
- তিনি আশঙ্কা করছেন যে তার পুত্র হুমায়ুনকে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না।"
- হুমায়ুনের চারপাশে যেন মৃত্যুর অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, যা বাবরকে আরও হতাশ করে তুলছে।
"রাজ্যের যত বিজ্ঞ হেকিম কবিরাজ দরবেশ,"
- রাজ্যের সকল সেরা চিকিৎসক, কবিরাজ ও দরবেশরা একত্রিত হয়েছেন।
"এসেছে সবাই দিতেছে বসিয়া ব্যবস্থা সবিশেষ।"
- তারা সবাই হুমায়ুনের সুস্থতার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ও ঔষধপত্র দিচ্ছেন।
"সেবাযত্নের বিধি-বিধানের ত্রুটি নাই একলেশ।"
- হুমায়ুনের সেবাযত্নে কোনো প্রকার ত্রুটি রাখা হচ্ছে না, কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
"তবু তার সেই দুরন্ত রোগ হটিতে নাকহায়," -
- এতকিছুর পরেও হুমায়ুনের কঠিন রোগ কিছুতেই সারছে না।
"যতদিন যায় দুর্ভোগ তার ততই বাড়িয়া যায়।" -
- দিনের পর দিন তার কষ্ট আরও বেড়ে চলেছে।
"জীবন প্রদীপ নিভিয়ে আসিছে অস্তরবির প্রায়।" -
- হুমায়ুনের জীবন প্রদীপ যেন অস্তগামী সূর্যের মতো ধীরে ধীরে নিভে আসছে।
"সুধালো বাবর ব্যাগ্র কন্ঠে ভীষক বৃন্দে ডাকি," -
- বাবর ব্যাকুল কণ্ঠে চিকিৎসকদের ডেকে বললেন।
"বল আজি সত্যি করিয়া দিও না কোমরে ফাঁকি।"
- তিনি তাদের অনুরোধ করলেন যেন তারা তাকে সত্যি কথা বলেন এবং কোনো কিছু গোপন না করেন।
"এই রোগ হতে বাচ্চা জাতার মুক্তি মিলিবে নাকি?"
- তিনি জানতে চাইলেন তার পুত্রের কি এই রোগ থেকে কোনোভাবে মুক্তি মিলবে?
"নতমস্তকে রহিল সবাই কহিল না কোন কথা," -
- চিকিৎসকরা মাথা নিচু করে রইলেন এবং কোনো কথা বললেন না।
"মুখর হইয়া উঠিল তাদের সে নিষ্ঠুর নীরবতা।" -
- তাদের এই নীরবতা বাবরের কাছে আরও বেদনাদায়ক হয়ে উঠলো।
"শল সমসী বাবরের বুকে বিধিল কিসের ব্যথা।" -
- এই নীরবতা যেন বাবরের বুকে তীক্ষ্ণ তীরের মতো বিঁধে গেল।
"হেনকালে এক দরবেশ উছি কহিলেন সুলতান," -
- এমন সময় একজন দরবেশ এসে বললেন।
"সবচেয়ে তবে শ্রেষ্ঠ যে ধন দিতে যদি পারোদান,"
- হে সুলতান, যদি আপনি আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ দান করতে পারেন।
"খুশি হয়ে তবে বাঁচাবে আল্লাহ বাদশা চাদার প্রাণ।"
- তাহলে আল্লাহ হয়তো খুশি হয়ে আপনার পুত্রের প্রাণ বাঁচাবেন।
"তখন শুনিয়া সে কথা কহিল বাবর সংকা নাহি গো মানি,"
- এই কথা শুনে বাবর কোনো দ্বিধা না করে বললেন।
"তাই যদি হয় প্রস্তুত আমি দিতে সেই কুরবানি।" -
- যদি এটাই উপায় হয়, তাহলে আমি সেই ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।
"সবচেয়ে মোর শ্রেষ্ঠ যে ধন জানি তাহা আমি জানি।"
- আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ কোনটি, তা আমি জানি (এখানে নিজের জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে)।
"এতেক বলিয়া আসন পাতিয়া নির্বিলি গৃহতল," -
- এই কথা বলে বাবর একটি নির্জন কক্ষে আসন পেতে বসলেন।
"গভীর ধ্যানে বসিল বাবর শান্ত অচঞ্চল।"
- তিনি শান্ত ও স্থির হয়ে গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন।
"প্রার্থনারত হাত দুটি তার নয়নে অশ্রুজল।" -
- প্রার্থনার সময় তার দু'চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল।
"কহিল কাদিয়া হে দয়াল খোদা হে রহিম রহমান,"
- তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হে দয়ালু আল্লাহ।
"মোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আমারই আপন প্রাণ।"
- আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় হলো আমার নিজের প্রাণ।
"তাই নিয়ে প্রভু পুত্রের প্রাণ করো মোরে প্রতিদান।"
- আমার এই প্রাণ নিয়ে আমার পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দাও।
"স্তব্ধ নীরব গৃহতল মুখে নাহি কারো বাণী,"
- বাবরের প্রার্থনার সময় পুরো প্রাসাদ নীরব হয়ে গেল, কেউ কোনো কথা বলছিল না।
"গভীর রজনী শক্তি মগন নিখিল বিশ্বরানী।"
- গভীর রাতে যখন পুরো বিশ্ব ঘুমিয়ে, তখন এই ঘটনা ঘটছে।
"আকাশে বাতাসে ধ্বনিতেছে যেন গোপন কি কানাকানি।"
- আকাশে-বাতাসে যেন কোনো গোপন কথা ছড়িয়ে পড়ছে (সম্ভবত হুমায়ুনের বেঁচে থাকার গুঞ্জন)।
"সহসা বাবর ফুকারি উঠিল নাহি ভয় নাহি ভয়,"
- হঠাৎ বাবর চিৎকার করে উঠলেন, আর কোনো ভয় নেই।
"প্রার্থনা মোর কবুল করেছে আল্লাহচি দয়াময়।"
- আমার প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেছেন।
"পুত্র আমার বাঁচিয়ে উঠিবে মরিবে না নিশ্চয়।"
- আমার পুত্র নিশ্চয়ই বেঁচে উঠবে, সে আর মরবে না।
"ঘুড়িতে লাগিল পুলুকে বাবর পুত্রের চারিপাশ,"
- বাবর আনন্দে হুমায়ুনের বিছানার চারপাশে ঘুরতে লাগলেন।
"নিরাশ হৃদয় সে যেন আশার দৃপ্ত জয় উল্লাস।"
- তার হতাশ হৃদয়ে যেন আশার আলো দেখা দিল, যা জয়ের উল্লাসের মতো ছিল।
"তিমির রাতের তরুণে তরুণে উষার পূর্বাভাস।"
- তার এই অনুভূতি ছিল অন্ধকার রাতের শেষে ভোরের আলোর মতো।
"সেইদিন হতে রোগ লক্ষণ দেখা দিল বাবরের,"
- সেই দিন থেকেই বাবরের শরীরে রোগের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করলো।
"হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করিল সজ্যা সে মরণের।"
- তিনি হাসিমুখে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন এবং শয্যাশায়ী হলেন।
"নতুন জীবনে হুমায়ুন ধীরে বাঁচিয়ে উঠিল ফের।"
- অন্যদিকে হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে নতুন জীবন ফিরে পেল।
"মরিল বাবর না ভুল কথা মৃত্যু কেতারে কয়,"
- বলা হয় বাবর মারা গেছেন, কিন্তু আসলে কি তাকে মৃত বলা যায়?
- বাবর মরেও অমর হয়েছেন, তার কোনো বিনাশ নেই।
- এখানে পিতার ভালোবাসার কাছে মৃত্যুও পরাজিত হয়েছে।